কত দিবস
কত সন্ধ্যানিশুতি
কত বর্ষ
কত যুগ
কত শতাব্দী পেরিয়ে-
তুমি এসেছ আমাদের ঘরে!
ক্লান্ত বহুত হয়েছ তবে-
বস, বস,
এবার শান্ত হও-
সুদীর্ঘ সরণী?
জানি, জানি,
তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে
জানি-
কারে মারতে হয়েছে ভগ্ননীড়ে?
কার প্রাসাদে মাল্যদান?
রাগ করো না বন্ধু,
তবু-
তবু তোমার আছে স্থান।
আরও সুন্দর করে সাজ তুমি পৃথিবী,
আরও সুন্দর হোক তোমার অগ্রগতি।
আজ থেকে চৌদ্দ শ বছর পূর্বে
যেমন কোলাহলে মেতেছিল পাখি,
যেমন উল্লাসে কীট-পোকা-মাছিরা ওঠেছিল ডাকি,
যেমন সানন্দ-পুলকে বোলতা-মধুকরে করেছিল গুঞ্জন,
যেমন হরষে ফুটেছিল কুসুম-
তেমন পুরাতনে আবার বস তুমি
জগজ্জননীর কোলে-
দেশকে বাঁচাতে হবে
আজি এ দুর্দিনের দুরবস্থা থেকে।
আমার হাতে দাও চৌদ্দ হাজার অগ্নিকৃপাণ-
আমার সাথে আসুক
যত অন্ধ- প্রতিবন্ধ, নিরানন্দ, অকিঞ্চন, মন্থরপুরুষ-
ওঠুক ডাক আকাশে-বাতাসে-
আগুন জ্বলুক,
জ্বলুক আগুন তেত্রিশ কোটি কঙ্কালের হাড়ে।
বন্ধুরা আয়,
ওই যে শ্মশান, ওই গোরস্থান;
যা- যা-
সেথা গিয়ে ডেকে আন সাড়ে তিন হাজার লক্ষ মৃতপ্রাণ।
যার যা কিছু আছে দু-করে টেনে ল কাছে-
দা, কাস্তে, কুঠার, খন্তা, কোদাল, শাণিত বিষাণ,
লাঠি, কঞ্চি, বাঁশের বাঁশুরি-
তুমি কী এনেছ ভাই?
‘দুই মুঠো ছাই- বেকার’
বেকার!
বেকার নয়-
সজোরে নিক্ষেপ কর ওইখানে-
তের লক্ষ দৈত্যদানবের চোখে-মুখে।
আজ সন্ত্রস্ত বাংলা
সম্পাতে কাঁদে-
ত্রাহি! ত্রাহি!
ভয়ভীতিশঙ্কায় কাঁপছে থরথর বঙ্গজননীর বুক!
যেখানে-সেখানে মারামারি, লুঠপাট, খুনখারাবি, ধর্ষণ,
রাহাজানি, চুরিডাকাতি, হত্যা : রক্তে রঞ্জিত পথ-
লাশ! লাশ!
মাঝপথে পড়ে আছে লাশ!
আমার স্ত্রী যেতে চায় না পিত্রালয়ে
আমার ভ্রাতা-ভগ্নী চায় না যেতে পাঠশালায়
আমার মাতা চমকি উঠে ঘুমঘোরে
আমার বাবা চাকরিতে গরহাজির
আমি পথ চলতে চকিতে খাই চৌদ্দ দোল
কার জন্যে রুদিত আজ অম্বরে-
কে রক্ষিবে দেশ?
রুধিবে এ ধ্বংসপ্রলয়গতি?
মিনতি- মিনতি-
তোরা কে যাবি?
আয় আমার সাথে-
আমি যুদ্ধক্ষেত্র নির্মাণ করেছি সুলভে
তোরা আয়, সুখের নিবাস ছেড়ে।
মা, দাও বিদায়-
তোমার স্নেহাশীর্বাদ : রৌদ্রাভিশাপ
আমাদের প্রেরণা যোগাবে : শক্তির সঞ্চার
আমি দুলদুলের লাগাম ছেড়ে হয়েছি ঘোড়সওয়ার
আমার দু-হাতে জুলফিকার তলোয়ার।
আজ দেশজুড়ে বাজবে আমার রণভেরী,
উঠবে ডাক মেঘনাদে সিংহের মতো গর্জি-
দে আমায় পরিয়ে দে ভয়াল মুখোশ;
তোরা এসেছিস ভাই?
বড় সুখের কথা
এবার জয়ধ্বনি উঠুক প্রলয়াতঙ্কে-
কে বলে? জনক তুমি বৃদ্ধ- শক্তিহীন!
কে বলে? জননী অবলা!
কে বলে? বোন যুবতী লজ্জাবতী-সুশীল!
কে বলে? ভ্রাতা ভদ্রনম্রাবোধ!
কে বলে? বধূ, নারী তুমি ঘরের প্রদীপ!
কে বলে? তোরা সব ভীরুকাপুরুষ!
কারা কাপুরুষ?-
হাঁ, হাঁ, তারা কাপুরুষ;
শালা, সব কুকুর-বিড়ালের ছানা
এখানে করেছে ভিড়,
ভেঙেছে নীড়;
কাঙালের ধন মেরে খায়,
গরিবদুখীদের উদরে করে পদাঘাত- ছোরাঘাত- অস্ত্রাঘাত
নিরীহদের করে লাঞ্ছিত-
মশামাছিতে দাবাই কামান
তারা বীর!
শালা, উত্তমের নেই কোথাও স্থান
কেবল ধ্বংস! কেবল বিনাশ!
যেখানে-সেখানে কলহবিবাদ-
মা-বোনদের চলায় চকিত-
রাস্তায় লাঞ্ছিত রমণী!
ও বলে, আমি বাংলার উত্তম পুত্র!
ও বলে, বাংলা আমার প্রিয় দেশ!
ও বলে, বাংলা আমার মনোজ্ঞ জন্মভূমি!
ও বলে, বাংলা আমার গগনছোঁয়া অহঙ্কার!
ও বলে, বাংলা আমার আমি বাংলার!
ও বলে, বাংলা আমার মধুর দেশ!
আমি বলি, বাংলা আমার মহান-মহীয়ান উদার মাতা!
আহা কোথায় ভ্রাতা!
যাঁদের বাণীরে করলাম পরিহাস
তাঁদের তরে বক্ষে জোড়লাম পাণি।
আজকে দেশের অবস্থা কত ঘোরতর!
কেউ আপন নেই-
সবাই পর! সবাই পর!
তুমি মসজিদ বানাবে?
দিতে হবে চাঁদা!
তুমি স্বপ্ন- কুঁড়ের ঘর বানাতে ইচ্ছুক?
দাও চাঁদা!
তুমি স্কুল-মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাকারী?
বন্ধু, গিয়েছ বড় ভুল করি!
সততায় বাঁচতে চাও?
বড় দুঃখের কথা!
সৎকর্ম করেছ কোথায়?
কালকে মরতে প্রস্তুত রও
কোথা মন্দির-মসজিদের সিঁড়িতে গুলী খায়!
শালা, দেশটাতে ইতর-গিধড়ের রাজ্য গড়ে উঠেছে আজ!
বাঁচার কোনও সম্মতি নেই!
একা করতে পারি না কিছু-
বন্ধু,
এ কী জীবন! এ কী জীবনী!
তাই-
লেখলাম বহু জনতার অগ্নিবাণী।
আমি আর পারলাম না ভাই,
আমার মুখোশ খুলে গেছে!
বন্ধু, আমি ধরা পড়ে গেছি!
‘সর্বনাশ’!
এখানে আমার মৃত্যু বারমাস।
আমি চলে যাচ্ছি-
বন্ধু,
চলে যাচ্ছি ক্ষণতরে!
আমার লাগি কেউ করো না খেদ-
কেঁদো না কোন বান্ধব,
আমি আবার আসব বাংলার দরিদ্রঘরে-
দারিদ্র্য-লোকালয়ে।
এই কর্ণফুলী নদীতীরে দাঁড়িয়ে
বত্রিশ কোটি নরনারী
এবং
আটষট্টি হাজার গ্রামবাসীরে
আবার দেখব নয়নভরে।
১৪ আশ্বিন, ১৪০৬-
আজমান, আমিরাত।